Friday || April 19, 2024 Online Tech News Portal
img

করোনা রেপিড টেস্ট কিট নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই

Posted on : 2020-05-11 07:46:53

News Source : আমাদের সময়, ১১ মে ২০২০ ০০:০০ | আপডেট: ১১ মে ২০২০ ১২:২৪

করোনা রেপিড টেস্ট কিট নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’- জীবনানন্দ দাশের কবিতার এ লাইনের মতোই মনে হচ্ছে আজ আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বিশ্বের জন্য নতুন হুমকি নোভেল করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বকে লন্ডভন্ড করে যাচ্ছে । তার তীব্রতা, আগ্রাসন বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। বেড়ে চলেছে সংক্রমণের সংখ্যা, বেড়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিল। বিভিন্ন দেশের যেমন রয়েছে সফলতার কাহিনি, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতার বেদনাদায়ক ঘটনা। যারা শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি-দিকনির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলেছে, তারা হয়েছে সফল আর যারা গুরুত্ব দেয়নি তাদেরই মোকাবিলা করতে হচ্ছে গভীরতম সংকট। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা, ঘরে অবস্থান, সামাজিক দূরত্ব যারা মেনে চলেছে কঠোরভাবে, তারাই হয়েছে করোনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি ও জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক পরামর্শ-নির্দেশনা দিয়ে আসছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নীতি-আদর্শে এ সংস্থাগুলো নির্ভরযোগ্য এবং সঠিক। বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এদের তথ্যকে সঠিক মনে করে অনুসরণ করেন। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে নানা গবেষণা, নানা পর্যালোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো গবেষণায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়নি। এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেক দিন। গবেষণার মূল বিষয়গুলো হলো-ভ্যাকসিন তৈরি, রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্তর নির্ণয়, ওষুধ উদ্ভাবন, রেপিড টেস্ট কিটের প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবহার, রোগ প্রতিরোধের সঠিক পদ্ধতি। আজকের এ প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে করোনা ভাইরাসের রোগ নির্ণয় পদ্ধতি।

ক. সঠিক রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি : আরটি-পিসিআর (রিভার্স টান্সক্রিপশন রিয়েল টাইম পলিমারেস চেইন রিঅ্যাকশন) হচ্ছে একমাত্র নির্ভরশীল, গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে পরীক্ষা করলে ফলাফল নির্ভুল বলে গৃহীত হয়। যে কোনো ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় ভুলত্রুটি হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। পরীক্ষার অনেকগুলো ধাপ আছে, যেমন-নমুনা সংগ্রহ, নমুনাটি যথাযথভাবে স্থাপন, মেশিনের যথাযথ কার্যকারিতা, ফলাফল পর্যবেক্ষণ। এর যে কোনো ধাপে যদি ভুল হয়ে যায়, তবে ফলাফল ভুল হতে পারে। এর পেছনে অবশ্যই প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ও টেকনোলজিস্ট থাকতেই হবে। বিশ্বব্যাপী আরটি-পিসিআরের মাধ্যমেই করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে এবং রোগীর সুস্থতা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

খ. রেপিড টেষ্ট কিট : এখন পর্যন্ত বিশ্বে কোথাও করোনা ভাইরাসের রোগ নির্ণয়ের জন্য রেপিড টেস্ট কিটের ব্যবহারের কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশ তাদের দেশীয় চিন্তাভাবনার প্রয়োগ করছে, তবে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও গবেষণা গৃহীত হয়েছে-

১. করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি একজন আক্রান্ত রোগীর শরীরে দুই-চার সপ্তাহের আগে তৈরি হয় না।

২. অ্যান্টিবডি পরীক্ষা রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত হয় না, রোগীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

৩. শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মানুষটি এক সময়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল, সে এখন আক্রান্ত আছে না সুস্থ অবস্থায় আছে, তা বোঝা যাবে না।

৪. ব্যাপক রোগ প্রতিরোধ অবস্থা সৃষ্টি (হার্ড ইমিউনিটি) : যখন একটা জনগোষ্ঠীতে অধিকসংখ্যক মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়, তখন সে মানুষগুলো কাছের মানুষদের আর সংক্রমণ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে এক ধরনের সামাজিক পরোক্ষ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং এ ধারণাটি থেকে বিভিন্ন দেশ তাদের লকডাউন প্রত্যাহারের ধাপ প্রস্তুত করতে পারে।

অ্যান্টিবডি পরীক্ষা কখন করতে হয় : যখন রোগীটি উপসর্গমুক্ত হবে, তার এক-দুই সপ্তাহ পর এ পরীক্ষা করলে শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি সাধারণত পাওয়া যায়।

অ্যান্টিবডির কাজ : এটি অ্যান্টিজেন বা ভাইরাসকে প্রতিহত করে, ধ্বংস করে এবং শরীর থেকে প্রত্যাহার করে।

অ্যান্টিবডি টেস্ট বা পরীক্ষার সঠিকতা (Accuracy) : তিনটি কারণে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা সঠিক ফলাফল নাও দিতে পারে।

১. মিথ্যা নেগেটিভ ফল : একজন মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার দু-চার সপ্তাহ পর সাধারণত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এর আগে পরীক্ষা করলে সেটি নেগেটিভ ফল দেবে।

২. মিথ্যা পজিটিভ : এখন পর্যন্ত সাত ধরনের করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। সপ্তম ভাইরাসের নাম হচ্ছে সার্স কভ-২। এর আগে যদি অন্য কোনো ভাইরাসের কারণে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি থাকে, তবে ওই অ্যান্টিবডির সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিথ্যা পজিটিভ ফল দিতে পারে।

৩. মিথ্যা নেগেটিভ : অনেক সময় আক্রান্ত রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মিথ্যা ফল পাওয়া যেতে পারে।

রেপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা : এ পরীক্ষাটাও এখন পর্যন্ত কোথাও অনুমতি পায়নি। বিশ্বের নামিদামি রিএজেন্ট প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেছে। কারণ নাক-মুখ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঠিতে (সোয়াব) ভাইরাস পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় কারণ করোনা ভাইরাস সাধারণত শ্বাসনালি ও ফুসফুসে বাসা বাঁধে, রক্তে উপস্থিতি অনিশ্চিত। সে কারণে সরাসরি সোয়াব বা রক্ত থেকে রেপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি। ই টোয়েন্টি ফাইভ বায়ো এবং ওরাসিউরের মতো বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিগুলো অন্যান্য ভাইরাসের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা উদ্ভাবন করলেও করোনা ভাইরাসের মতো শ্বাসনালির ভাইরাসের অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় আগ্রহ দেখায়নি।

সাধারণত আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগে। ইতোমধ্যে বিখ্যাত কোম্পানি এবোট যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ মিনিটে এ পরীক্ষা করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যা এখন সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে।

রেপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশের অবস্থান :

১. যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অনুমোদিত অ্যান্টিবডি টেস্টের লেভেলে লেখা থাকতে হবে-`Results from antibody should not be used as the sole basis to diagnose or excludes SARS-Cov-2 (Covid 19) infection status'

২. যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে ৩৫ লাখ অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট ক্রয় করেছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা না পাওয়ায় ব্যবহার করছে না। বরং জনগণের জন্য `Coronavirus: Double warnings over antibody test' দিয়ে রেখেছে।

৩. যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডোমিকস কোম্পানি বিশ্বে করোনার জন্য প্রথম রেপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট উদ্ভাবন করে এবং চীনে স্ক্রিনিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যবহার করে। উপসর্গসহ বা উপসর্গবিহীন সব রোগীর ক্ষেত্রে স্ক্রিনিংয়ের জন্য এ পরীক্ষাটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. অ্যান্টিবডি টেস্ট মহামারীর শেষ পর্যায়ে বেশি প্রয়োজন হবে। যুক্তরাজ্যে মে মাসের শেষ দিকে অ্যান্টিবডি টেস্টের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। জার্মানি ও ইতালি এ পরীক্ষা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ চারটি কোম্পানিকে অনুমতি দিয়েছে।

বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য রেপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে প্রক্রিয়া চলছে। এটি বিশ্বের জন্য নতুন না হলেও বাংলাদেশের একটি সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে এটিও আমাদের জন্য কম গৌরবের নয়। আমরা দেশের মানুষ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি, অভিনন্দন জানিয়েছি। কিন্তু গণস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষই অহেতুক কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাঁরা প্রথমেই ঘোষণা দিয়েছে এটি স্বল্পমূল্যে, ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে এবং পাঁচ কোটি মানুষের পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে। তারা বাংলাদেশের সরকার, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সংস্থা সবাইকে উপেক্ষা করেই সবকিছু করে ফেলতে চেয়েছে। যেহেতু জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয়তা ভেবে সরকার শুরু থেকেই সব সহযোগিতা করেছে, যেটি কখনো অন্য কোনো সংস্থার জন্য করা হয়নি বা করার প্রয়োজন পড়ে না, সবই নিয়মতান্ত্রিকভাবে এমনিতে হয়ে যায়। গণস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সরকারের সব বিধি উপেক্ষা করতে চেয়েছে, যা এ রকম একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর উদ্ভাবন বিশ্বের এক স্পর্শকাতর সময়ে অসম্ভব। দেশে যে কোনো উদ্ভাবনের জন্য বিএমআরসির পূর্বানুমোদন বাধ্যতামূলক। অননুমোদিত একটি পরীক্ষা কিট সরকারের মন্ত্রী বা সরকারের একটি দায়িত্বশীল অফিস গ্রহণ করবে, এটি একেবারেই আইনবহির্ভূত। সেরোলজি পরীক্ষা বাংলাদেশে একটি সাধারণ পরীক্ষা, অন্য রোগের জন্য অহরহ হয়ে থাকে। মানসম্পন্ন রিএজেন্ট থাকলে সিআরওতে গণস্বাস্থ্যের পরীক্ষা বাতিল হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইতোমধ্যে এ ধরনের কিটে গোটা বিশ্ব সয়লাব হয়ে গেছে। অনেকে বাংলাদেশে আরও সস্তা দামে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি ব্যতিরেকে এটির ব্যবহার হবে আত্মঘাতী।

যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ অত্যন্ত শক্তিশালী সংস্থা, যে কারণে আমেরিকাবাসী সব খাবার ও ওষুধ নিশ্চিন্তে খেতে পারে। সংস্থাটি রেপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট সম্পর্কে বলেছে, এ পরীক্ষাটি আমাদের করোনার বিরুদ্ধে আগামী পদক্ষেপে ভালো নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে, যেমন-১. রোগের প্রাদুর্ভাব এবং উপসর্গবিহীন রোগীর সরবরাহ করবে; ২. ‘কনভালেসেন্ট প্লজমা’ ডোনার শনাক্ত করতে সহায়তা করবে, যার মাধ্যমে মরণাপন্ন কোভিড রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি সঞ্চালন করা যেতে পারে।

এফডিএ সেরোলজি (অ্যান্টিবডি) পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় না করে সংক্রমিত রোগীর তথ্য সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহার করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা দিয়েছে যে, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখায়, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হবে না, এমন নিশ্চয়তা প্রমাণ করে না।

বিশ্ব আজ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি। এ সময়ে আমাদের সবাইকে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সম্মিলিতভাবে লড়াই করতে হবে-বেঁচে থাকার জন্য, আগামী সুন্দর পৃথিবীর জন্য।

অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ

জাতীয়