Thursday || March 28, 2024 Online Tech News Portal
img

‘কারখানা খুলে দেওয়া হবে আত্মঘাতী’

Posted on : 2020-05-03 06:00:36

News Source : আমাদের সময়, ৩ মে ২০২০ ০০:০০ | আপডেট: ৩ মে ২০২০ ০৯:৫০

‘কারখানা খুলে দেওয়া হবে আত্মঘাতী’

দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। মৃতের সংখ্যা ২শ ছুঁই ছুঁই। জনমনে দিন দিন আতঙ্ক বাড়ছেই। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা মানুষকে ঘরে থাকা ও সামাজিক দূরুত্ব নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। ভারতে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে লকডাউন দিন দিন শিথিলই হচ্ছে। ইতোমধ্যে সহস্রাধিক গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।

গত ১২ এপ্রিল গাজীপুরের একটি কারখানায় সাত শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হন। এ ছাড়া আরও বেশকিছু কারখানায় শ্রমিক আক্রান্তের খবর গণমাধ্যমে আসছে। এমন অবস্থায় গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে খোলার সিদ্ধান্ত নিতে আজ রবিবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দুপুর ১২টার এ সভায় বেশ কয়েক সচিবসহ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, সভায় সীমিত আকারে শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে তারা সরকারকে অনুরোধ জানাবেন। কারণ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শ্রমিক ও মালিক উভয়পক্ষই মারাত্মক ক্ষতিতে পড়েছে। ভেঙে পড়ছে দেশের অর্থনীতি। দরিদ্র মানুষের হাহাকার বাড়ছে। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা খোলার বিকল্প নেই। তবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তারা এসব খুলতে চান।

এদিকে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো হুশিয়ারি করে বলছে, লকডাউন শিথিল করার সময় এখনো আসেনি। লকডাউন তুললে চরম মূল্য দিতে হবে। গত ১৬ এপ্রিল সংস্থাটি জানায়, যে দেশগুলো লকডাউন শিথিল করতে চাচ্ছে, তাদের অবশ্যই ছয়টি শর্ত মেনে নিতে হবে। যেন দ্বিতীয় দফায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে। সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস বলেন, এখনই লকডাউন শিথিল করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবু কোনো দেশ যদি সে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে অত্যন্ত সতর্ককতার সাঙ্গে পা ফেলতে হবে। প্রথমত, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। অর্থাৎ প্রত্যেক আক্রান্ত ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়ার যাবতীয় তথ্য সরকারের থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের করোনা ভাইরাস পরীক্ষার শতভাগ সক্ষমতা থাকবে হবে। এর পর প্রত্যেক আক্রান্ত ব্যক্তিকে নজরদারির মধ্যে রেখে তার মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানো রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, হাসপাতালের মতো করোনা হটস্পটগুলোকে সব সময় জীবাণুমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জনসমাগমপূর্ণ সব জায়গায় সংক্রমণ রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিত শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখতে হবে, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে ও সাবান-পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। পঞ্চমত, বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। বিদেশ ফেরতদের দেশে ফেরা মাত্র কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। আর শেষ শর্তটি হলো, করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা যে নতুন সামাজিক আচরণ শিখেছি তা যেন ধরে রাখি। প্রয়োজনে জনগণকে বারবার সচেতন করতে হবে, নতুন করে সংক্রমণ ঠেকাতে এর বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা যে ছয়টি শর্তের কথা বলেছে তা নিশ্চিত করতে পারছে না বাংলাদেশ। এখানে পর্যাপ্ত পরীক্ষারই ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকরা সামাজিক দূরত্ব বিষয়টাই বুঝতে চাচ্ছে না। বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা যায়নি এবং যাচ্ছেও না। ফলে নতুন করে আরও কলকারখানা ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হলে চরম মূল্য দিতে হবে। সংকট এত বেশি গভীরে যাবে, তা থেকে বের হওয়া কঠিনই হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, গার্মেনটসসহ কোনো কারখানাই এখন খোলা উচিত হবে না। কারণ অর্থনীতির চেয়ে জীবন বেশি মূল্যবান। আর যদি খুলতেই হয় তা হলে কিছু বিষয় অবশ্যই মানতে হবে। যেমন- প্রকৃতই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশের আগে অবশ্যই সাবান দিতে হাত ধুবেন। কারখানায় ঢোকার সময় ডিসইন্যাক্ট্যান্ট টানেল বা আর্চ দিয়ে ঢুকতে হবে। কারখানার প্রতিটি মেশিন কমপক্ষে তিন ফুট দূরে দূরে বসাতে হবে। প্রত্যেক শ্রমিককে সার্জিক্যাল মাস্ক পরাতে হবে। তাদের জন্য টয়লেটের সংখ্যা বাড়াতে হবে। টয়লেটগুলো প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পুরো কারখানা কমপক্ষে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর ডিসইনফ্যাক্ট্যান্ট করতে হবে। সম্ভব হলে এটা আরও কম সময় পরপর করতে হবে। যেন কোনোভাবেই কারখানার ভেতরে জীবাণু জন্মাতে না পারে। কারখানা খোলার আগে ও পরে ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা যেখানে থাকে সেখানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মেনে থাকার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তারা যেন ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে, সে জন্য তাদের সচেতন করতে হবে।

বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক এই উপদেষ্টা আরও বলেন, আর কোনো গার্মেন্টস কিংবা অন্য শিল্পকারখানা কোনোভাবেই খোলা সমীচীন হবে না। এটি ভয়ঙ্কর হবে। আর যদি খুলতেই হয় তা হলে অবশ্যই বিশ^স্বাস্থ্য সংসথার গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে। এ গাইডলাইনকে কৌশল হিসেবে নিতে হবে। তিনি বলেন, বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে ছয়টি শর্ত দিয়েছে, সেগুলো অনুসরণ করতেই হবে। এগুলো মানতে না পারলে মহামারী মহাবিপর্যয়ে রূপ নেবে বলেও আশঙ্কা করেন প্রফেসর মোজাহেরুল হক।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব আমাদের সময়কে বলেন, করোনার এ সংকটে জীবন ও জীবিকা দুটোই মহাসংকটে। সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ নিশ্চিত করে কলকারখানা খোলা রাখতে হবে। আর স্বাস্থ্য বিধি রক্ষা করতে না পারলে কলকারখানা খোলার প্রয়োজন নেই। কারণ এতে সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে শিল্পকারখানার খোলা রাখার পক্ষেই মত দিলেন অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।

করোনার এ নাজুক পরিস্থিতিতে ব্যবসা ও শিল্পকারখানা খোলা সমীচীন হবে কিনা এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ও করোনাকালীন সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. শাহ মনির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, আমরা বারবার গার্মেন্টস খুলতে নিষেধ করেছি। তবু গার্মেন্টস খোলা হয়েছে। অথচ শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারছেন না। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পথ পরিষ্কার হলো। তিনি আরও বলেন, সামনে যদি অন্যান্য কারখানাও খোলে, তা হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

শাহ মনির আরও বলেন, আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু বাড়ছে। যদি আক্রান্তের সংখ্যাটা কমে আসত, তা হলে আমরা হয়তো সরকারকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলকারকানা খোলার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু সে রকম পরিস্থিতি হয়নি। সুতরাং বাদবাকি গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প কারখানা খুলে দিলে করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার নেবে। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হাজার হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং এখনই লকডাউন শিথিল কিংবা কলকারখানা কোনোভাবেই খোলা উচিত নয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আজকের সভায় জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, শিল্প মন্ত্রণলেয়র সচিব, শ্রম সচিব, বাণিজ্য সচিব, আইজিপি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি, বিজিএমইএ সভাপতি, ডিসিসিআই সভাপতি, বিকেএমইএ সভাপতি, বিটিএমইএ সভাপতি, এমসিসিআই সভাপতি এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

জাতীয়